কী করে পাবেন সফল উদ্যোক্তাদের মেন্টরশিপ?
প্রথমবারের মত কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয় যার মাঝে অন্যতম হচ্ছে উপযুক্ত উপদেষ্টা কিংবা মেন্টরের অভাব, যার প্রথম কারণ হচ্ছে, আমরা অনেকেই জানি না কিভাবে কিংবা কোন জায়গা থেকে একজন মেন্টরের সংস্পর্শে আসা যায়। একজন সঠিক মেন্টর আপনার ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠাকালীন এবং পরবর্তী সময়ের ঝঞ্ঝা অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে, এছাড়াও আপনার সামনে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে যা আপনি আগে কখনো চিন্তাও করেননি। এই ব্লগটিতে থাকছে, কিভাবে আপনি একজন ভাল মেন্টরের সন্ধান ও সান্নিধ্য পেতে পারেন।
কোথা থেকে পাবেন ভাল মেন্টরের সন্ধান।
১। বিভিন্ন নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট ও ফেসবুক কমিউনিটি
ফেসবুকে বিভিন্ন ব্যবসায় ও উদ্যোক্তা সম্পর্কিত গ্রুপ রয়েছে যেখানে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যেই নতুন ব্যবসায়ীদের উপদেশ দিয়ে থাকে। এসব গ্রুপে প্রায়শই বিভিন্ন ক্ষেত্রের সফল উদ্যোক্তার সন্ধান পাওয়া যায় এবন সক্রিয় থাকলে তাঁদের সান্নিধ্যেও আসা যায়। এছাড়াও সারা বছর উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন রকমের নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট আয়োজিত হয় যার খবরও এসব গ্রুপ থেকে পাওয়া যায়, অনেক সময় ইভেন্টগুলো হয়ও এসব গ্রুপেরই সৌজন্যে। তবে এসব ইভেন্টে গিয়ে যত বেশি সম্ভব মানুষের সাথে কথা বলতে হবে এবং পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করতে হবে।
২। লিংকডইন
ক্যারিয়ার সম্পর্কিত যেকোনো কাজেই লিংকডইন একটি বহুল ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক। লিংকডইনের নিজস্ব মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম রয়েছে যেখানে আপনি অটোমেটেডভাবে মেন্টর পেয়ে যাবেন, আবার ব্যক্তিগত উদ্যোগেই আপনি অনেকের সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন।
৩। ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সহায়তা করে থাকে যেমন, মাইডাস। এর মাঝে বেশিরভাগ আবার বিনামূল্যেই সহায়তা দান করে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সঠিক মেন্টরের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে।
৪। সমসাময়িক অন্যান্য ব্যবসায়ী
সরাসরি আপনার পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করছে এমন কেউ আপনাকে সহায়তা করতে অনিচ্ছুক হলেও ভিন্ন পণ্যের ব্যবসায়ীদের থেকে আপনি অনেকাংশেই সাহায্য পাবেন। তারা ইতোমধ্যে অনেক রকমের প্রতিকূলতা পার করে এসেছে যা আপনি পরবর্তীতে পেতে যাচ্ছেন, সেক্ষেত্রে তারা আপনাকে সুন্দরমত পথপ্রদর্শন করতে পারবে।
৫। প্রচারেই প্রসার
আপনার উদ্যোগের কথা মানুষকে জানান, আপনার পরিচিত মানুষের মাঝেই দেখবেন অনেকেই আপনার উদ্যোগের কথা শুনে আপনাকে হঠাৎ করেই কোনো মেন্টরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে যার সান্নিধ্যে হয়ত আপনি নিজে থেকে কখনোই আসতে পারতেন না।
কিভাবে বুঝবেন যে আপনার চিহ্নিত মেন্টরটি আপনার জন্য সঠিক
বিখ্যাত ভাষ্কর মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতে, প্রত্যেকটি পাথরের মাঝেই একটি ভাষ্কর্য সুপ্ত থাকে, একজন সফল ভাষ্করের কাজ হচ্ছে সেই ভাষ্কর্যটিকে বের করে আনা। একজন মেন্টরও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রত্যেক মানুষের মাঝে সুপ্ত সফল উদ্যোক্তাকে বের করে আনাই একজন মেন্টরের কাজ। অনেক ব্যক্তিই নিজ ক্ষেত্রে অনেক সফল হলেও একজন মেন্টর হিসেবে খুব একটা ভাল হয় না তাই যাতে ভুল মানুষের কাছে গিয়ে আপনার মূল্যবান সময় অপচয় না হয় তাই শুরুতেই তিনটি বিষয় লক্ষ্য করা উচিৎ, যাকে একসাথে বলা হয় থ্রি এ (3A)।
উপস্থিতি (Availability): উপস্থিতি মানে একজন মেন্টর হিসেবে, একজন মানুষের উচিৎ তার ধারণা, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা এবং উপলব্ধি আপনার সামনে প্রকাশ করা। এর অর্থ হল, তাকে আপনার সামনে সৎ এবং স্বচ্ছ হওয়া যাতে আপনি তার উপর আস্থা রাখতে পারেন এবং তার সাথে আপনার সম্পর্ক উন্নত হয়।
সুতরাং, আপনার মেন্টরকে আপনার জন্য উপস্থিত থাকতে হবে। আপনার জন্য সময় দেওয়া এবং একের পর এক সাক্ষাৎ করা ছাড়াও, তাকে আরও অনেক উপায়ে উপস্থিত থাকতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, তাদের শুধু শারীরিকভাবেই নয় বরং মানসিকভাবেও উপস্থিত থাকতে হবে। এর মানে হল, যখন আপনার খারাপ সময় যাবে, তখন আপনাকে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করার জন্য তাকে আপনাকে প্রয়োজনীয় মানসিক সমর্থন দিতে হবে।
এমনকি যদি আপনার মেন্টর সর্বদা উপস্থিত নাও থাকতে পারে, তাকে আপনার ব্যবসায়ের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। তাকে বুঝতে হবে যে আপনি যখন সফল হন, তখন তিনিও সফল হয়। আপনি সহজেই জানতে পারবেন আপনার মেন্টরের কথাবার্তা এবং আপনার প্রতি আচরণ থেকে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, তিনি আপনার ব্যবসায়ের প্রতি কতটুকু যত্নশীল।
পরামর্শদাতার উপস্থিতির আরেকটি ভাল উদাহরণ হল, আপনার অনেক জরুরী প্রয়োজনের সময় তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে যোগাযোগে দেরি করবেন না।
সক্রিয় শ্রোতা (Active listener): মেন্টরশিপ সবসময় একটি টু-ওয়ে-কমিউনিকেশন হতে হবে। একজন ভাল শিক্ষক কিংবা মেন্টর সবসময় একজন ভাল শ্রোতা হবেন এবং তিনি যাকে শেখাচ্ছেন, তার কথা মন দিয়ে শুনবেন।
আপনার মেন্টর যেভাবে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেন তার মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন তিনি একজন ভাল শ্রোতা কিনা। যদি তিনি সবসময় আপনাকে এমন উত্তর দেয় যা আপনাকে আরও বেশি কৌতুহলি করে তুলবে, তাহলে এর মানে তিনি আপনার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে না।
একজন ভাল শ্রোতা আপনাকে অনেক প্রশ্ন করবে এবং বেশিরভাগ সময় প্রশ্ন করতে করতেই আপনার ভেতর থেকেই আপনার প্রশ্নের উত্তর বের করে নিয়ে আসবে। মনে রাখবেন যে, মেন্টর সবসময় আপনাকে আপনার সব সমস্যার সমাধান দিবেন না বরং আপনি নিজেই যেন সমস্যা সমাধান করতে পারেন, আপনাকে সেভাবে তৈরি করবে।
দক্ষ (Analytic): যেহেতু সময় সর্বদা সীমিত, তাই আপনার মেন্টরের সাথে কাটানো অল্প সময়ের থেকে আপনাকে সর্বাধিক মূল্য পেতে হবে। সুতরাং, আপনার মেন্টরের আপনার প্রশ্নের উত্তর সাথে সাথে দেয়ার দক্ষতা থাকতে হবে। এছাড়াও তাকে বিভিন্ন বিষয় আপ-টু-ডেট থাকতে হবে কারণ ব্যবসায়ের জগত সর্বদা পরিবর্তনশীল। এতে করে তার উত্তরগুলো বাস্তবসম্মত হবে।
কী ধরনের বিষয় দিয়ে মেন্টরের সাথে কথা বলা শুরু করবেন
মেন্টরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে আপনাকে জানতে হবে কী কী বিষয় তার সাথে কথা বলা উচিৎ। শুধুমাত্র ব্যবসায় নিয়ে কথা বললে, আপনার মেন্টরের দেয়া গাইডেন্স অনেকসময় সার্বজনীন হয়ে যাবে এবং তা ব্যক্তিগতভাবে আপনার খুব একটা উপকারে আসবে না।
১। আপনাদের কাজের মাঝে কতটুকু কী মিল আছে, এতে করে আপনাদের একে অপরকে বুঝতে সুবিধা হবে।
২। আপনার শক্তি এবং দূর্বলতার কথা। এসব জানলে, আপনার মেন্টরের আপনার অবস্থা বুঝতে এবং এই অবস্থায় আপনি কিভাবে আপনার সেরাটা দিতে পারেন, সেটা বলাটা সহজ হবে।
৩। আপনার প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জগুলো। একই ব্যবসায় থাকলেও, সবার চ্যালেঞ্জ একই হয় না। চ্যালেঞ্জভেদে পরামর্শও ভিন্ন হয়।
৪। আপনার লক্ষ্য। চ্যালেঞ্জের মত, একই ব্যবসায় থাকলেও লক্ষ্য ভিন্ন হতে পারে। লক্ষ্য জানা থাকলে, আপনার মেন্টরের পরামর্শও সেই ভিত্তিতে হবে।
৫। আপনি যেসব দক্ষতা অর্জন করতে চান এবং তাতে কী কী জিনিস আপনাকে বাধা দিচ্ছে। এসব জানা থাকলে, আপনার মেন্টরের আপনার নির্দিষ্ট বাধাগুলো অতিক্রম করার জন্য পরামর্শ দার করা আরো সহজ হবে।
এর বাইরেও, মেন্টর আপনাকে তখনই সাহায্য করতে পারবে যখন আপনি নিজে নিজেকে সাহায্য করবেন। মেন্টর আপনাকে সাফল্য এনে দিবে না, তার কাজ শুধু পরামর্শ দেয়া পর্যন্তই, সেই পরামর্শ আপনি কিভাবে কাজে লাগাবেন, সেটা আপনার উপর নির্ভর করছে। মেন্টরশিপ নেয়ার সময় কখনো সাহায্য চাইতে এবং আপনার সমস্যার কথা জানাতে পিছপা হবেন না। সাহায্য না চাইলে কেউই আপনাকে নিজে থেকে এসে সাহায্য করবে না এবং নিজের সমস্যার কথা নিজে না জানালে কেউই তা নিজে থেকে বের করে নিবে না।